Details
1302

কৃষ্ণগহ্বর

কৃষ্ণগহ্বর

মুসা আহমেদ আকিব

 

তা আপনি বিজ্ঞানের ছাত্র হন আর নাই বা হন, ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর এর নাম আপনি এতদিনে নিশ্চয়ই শুনেছেন। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাকহোলের ছবি প্রকাশ করায় এই ব্যাপারে অনেকেরই নতুন করে আগ্রহ জন্মেছে। অসংখ্য কৌতূহলী মন জানতে চায় ব্ল্যাকহোল আসলে কী? আপনাকে জানানোর দায়িত্ব আমার, আপনি শুধু একটু সময় নিয়ে লেখাটা পড়ে ফেলুন!

 

ব্ল্যাকহোল

 

‘ব্ল্যাকহোল’ শব্দটি শুনে যদি আপনার মনে কোনো গর্তের ছবি ভেসে উঠে তবে তা ঝেড়ে ফেলুন। তবে হ্যা, বড়সড় গর্তে কিছু পড়লে যেমন তা হারিয়ে যায়, ব্ল্যাকহোল একবার টেনে নিলেও তা হারিয়ে যায় চিরকালের জন্য। কিন্তু গর্তে পড়লে আপনি হারানো জিনিসটি খুজে পেলেও পেতে পারেন, সে সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু ব্ল্যাকহোল টেনে নিলে তা পাওয়া একেবারেই অসম্ভব। আপনি হয়তো লক্ষ্য করেছেন ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রে আমি বারবার ‘টেনে নেওয়া’ শব্দটি ব্যবহার করছি! এটাই তো ব্ল্যাকহোলের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, এর মহাজাগতিক আকর্ষন টেনে নেয় সব কিছু! আলো ছুটে চলেছে মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ গতিবেগে, সেকেন্ডে তা প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার। এই আলোর পক্ষেও সম্ভব হয় না কোনো ব্ল্যাকহোলের মহাজাগতিক আকর্ষনকে ফাঁকি দেয়া! তাহলে কল্পনা করুন এই আকর্ষন বলের পরিমাণ কতটা বেশি! এই মহাজাগতিক প্রবল আকর্ষণ তৈরি করার জন্য চাই অসম্ভব রকমের বেশি ভর আর ঘনত্ব। সোজা কথায় খুব অল্প জায়গায় যদি অনেক বেশি ভর ঘনীভূত হয়ে থাকে তখন তাকে ব্ল্যাকহোল বলা হয়৷ ব্ল্যাকহোলের নামকরণ করেন বিজ্ঞানী জন হুইলার। ইতিহাসের দিকে না গিয়ে শুধুমাত্র ব্ল্যাকহোল সম্পর্কেই না হয় আলোচনা করা যাক!

 

মানুষ মরে ভুত হয় নাকি সে বিতর্ক থাকতেই পারে তবে ‘তারা’ মরে কী হয় তা কিন্তু আমরা জেনে গিয়েছি! ঠিকই ধরেছেন আমি আকাশের তারা ইংরেজিতে যাকে বলে STAR এর কথাই বলছি। মানুষের মতো অসুখ বিসুখে তারাদের মরা লাগে না, তবে তাদেরও জীবনচক্র আছে৷ জন্ম যেমন আছে তেমনি জ্বালানী ফুরিয়ে গেলে হয় মৃত্যু। একেকটা তারা, আমাদের সূর্যের কথাই ধরুন, ভাবুন তো দেখি কত্ত বিশাল! আমাদের সূর্য থেকেও কয়েকগুন বড় হাজার হাজার তারা খুজে পাওয়া গিয়েছে এই মহাবিশ্বে৷ এদের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রও যে কত বিশাল তা আপনার হয়তো কল্পনারও বাইরে (মহাকর্ষ বল নির্ভর করে ভরের উপর, ভর যত বেশি মহাকর্ষ বলও তত বেশি)। বিশাল এই মহাকর্ষের ফলে তারাগুলোর অনেক আগেই চুপসে যাওয়ার কথা। অর্থাৎ সংকুচিত হয়ে যাওয়ার কথা। নিউক্লিয়ার ফিউশনে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম যতদিন উৎপন্ন হয় ততোদিন কোনো তারাই সংকুচিত হয় না। জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে অর্থাৎ সঞ্চিত হাইড্রোজেন শেষ হয়ে গেলে আর ফিউশন বিক্রিয়া ঘটে না। ফলে কেন্দ্রবহির্মুখী যেই বলটা কাজ করতো তা আর থাকে না। থাকে শুধু কেন্দ্রমুখী মহাকর্ষ বল। অতঃপর নোভা বা সুপার নোভার মাধ্যমে তারার মৃত্যু ঘটে। এই সুযোগে মহাকর্ষ তার সব ক্ষমতা খাটিয়ে তারাকে সংকুচিত করে ফেলে। তারার বিশাল ভর একটা ক্ষুদ্র অঞ্চলে ঘনীভূত হয়। তারার ভরের উপর নির্ভর করে উৎপন্ন হয় শ্বেত বামন, নিউট্রন স্টার এবং ব্ল্যাকহোল! সব তারার পক্ষে ‘মৃত্যুর’ পর ব্ল্যাকহোলে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের সূর্যই মৃত্যুর পর শ্বেত বামনে পরিণত হবে। মোটামুটি ভাবে বলা যায় সূর্য থেকে ২০ গুণ বড় যেসব তারা আছে অর্থাৎ যেসব তারার ভর সূর্য থেকে ২০ গুণ বা তার বেশি সেগুলোই ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়৷ তারার এই বিশাল ভর যখন সংকুচিত হয়, তখন তুলনামূলক ভাবে খুব কম জায়গায় ঘনীভূত হয়৷ এ এক বিশাল ব্যাপার, সূর্যের বিশালতা যেখনে আমাদের অবাক করে সেখানে ২০ টা সূর্যের সমান তারারা পরিণত হয় ব্ল্যাকহোলে!

 

তাহলে ব্ল্যাকহোল কিভাবে তৈরি হয় তাতো জানা গেল (তারার জ্বালানি শেষ হয়ে যাওয়ার ফলে নিউক্লিয়ার ফিউশনে আর কেন্দ্রবহির্মুখী বল তৈরি হয় না, শুধু থাকে তারার প্রবল মহাকর্ষীয় বল যার ফলে তারা সংকুচিত হয় এবং অতি বৃহৎ তারার ক্ষেত্রে ব্ল্যাকহোলে রূপান্তরিত হয়)। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন ব্ল্যাকহোল থেকে কোনো কিছু বেরিয়ে আসতে পারে না? ব্যাপারটা বুঝতে হলে মুক্তিবেগ সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। সোজা কথায় হচ্ছে মুক্তিবেগ বলতে এমন বেগ বুঝায় যা কোনো বস্তুর মহাকর্ষীয় শক্তিকে ফাঁকি দিতে পারে। এই যেমন ধরুন পৃথিবীর মুক্তিবেগ হচ্ছে সেকেন্ডে ১১.২ কি.মি.। অর্থাৎ কোনো বস্তু যদি সেকেন্ডে এই বেগের বেশি বেগে চলে তাহলে পৃথিবীর মহাকর্ষকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তা চলে যাবে মহাশুন্যে। কিন্তু যদি কোনো বস্তুর বেগ এর থেকে কম হয় তবে যত চেষ্টাই করা হোক না কেন  সেটাকে পৃথিবী থেকে বের করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর মহাকর্ষ টেনে ধরে রাখবে বস্তুটিকে। ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রে এই মুক্তিবেগ আলোর বেগে থেকে বেশি! অর্থাৎ আলোর বেগ থেকে বেশি বেগে যদি কোনো কণা ছুটতে পারে তবে ব্ল্যাকহোল থেকে বেরুতে পারবে। কিন্তু আলোর বেগের থেকে জোরে ছোটা সম্ভব নয়। তাই ব্ল্যাকহোল থেকে বেরুতে পারে না কিছু, এমনকি আলো ও! তবে ব্ল্যাকহোলের মহাকর্ষ বুঝতে হলে মহাকর্ষকে নতুন করে চিনতে হবে।

 

নিউটনের মাথায় আপেল পড়েছিল নাকি তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু একথা কেউ অস্বীকার করবে না যে নিউটনই আমাদের মহাকর্ষের সাথে পরিচয় করিয়েছিলেন। আর মহাকর্ষকে নতুন করে চিনতে শিখিয়েছিলেন আইনস্টাইন। আইনস্টাইনকে বলা হয়ে থাকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তি! অসাধারণ মানুষদের মতো ওনার চিন্তাভাবনাও ছিল অসাধারণ। সময়কে তিনি প্রথম মাত্রা হিসেবে কল্পনা করেন, বলেন যে সময় একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। ব্যাপারটা বুঝানোর জন্য একটা উদাহরণ দেয়া যাক। ধরুন আপনি ডাক্তার দেখাবেন, সিরিয়াল নিয়ে বসে আছেন। এক ঘন্টাই আপনার কাছে অনন্তকাল মনে হবে। কিন্তু এই আপনিই যদি এই একঘন্টা প্রিয় কোনো কাজ, এই যেমন ধরুন ফেসবুকিং বা প্রিয় কোনো মানুষের সাথে কাটালেন মনে হবে যেন খুব দ্রুতই যেন একটা ঘন্টা চলে গেল! সময় কিন্তু ছিল ঐ এক ঘন্টাই, আপনার কাছে দু’ক্ষেত্রে দুরকম মনে হয়েছে। এটাই হলো খুব সহজ ভাষায় আপেক্ষিকতা। আইনস্টাইন কিন্তু নিউটনের মতো মহাকর্ষকে আকর্ষণ দিয়ে চিন্তা করেননি বরং মহাকর্ষকে তিনি বলেছিলেন স্থানকালের বক্রতা। তাঁর মতে ভারী বস্তু তার আশেপাশের স্থানকাল বাঁকিয়ে দেয়।

 

ব্ল্যাকহোল

 

 

বুঝিয়ে বলি, ধরুন একটা বিছানার চাদর নিয়ে আপনি চারটি খুটিতে টানটান করে বাঁধলেন। মাঝখানে রাখলেন বড় এবং ভারী একটা নিরেট বল। কী হবে? নিশ্চয়ই মাঝখানটা ডেবে যাবে। এবার যদি আপনি চাদরে কোনো মারবেল রেখে ঘুরিয়ে দেন দেখবেন মারবেলটা সেই ডেবে যাওয়া অংশের দিকেই যাচ্ছে। এটাই স্থানের বক্রতা। আমাদের সূর্য আশেপাশের স্থান বাকিয়ে গ্রহগুলোর কক্ষপথ তৈরি করেছে। ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রে এই স্থানকালের বক্রতা হয় অসীম। এই বক্রতাকেই আমি আকর্ষণ বলছি (নিউটনের ভাষায়)। স্থানের সাথে বারবার কালের তথা সময়ের বক্রতার কথাও আমি বলছি, উদাহরণ দেয়া যাক। স্থানের মতো ভারী বস্তু তার আশেপাশের কালকেও বাকিয়ে দেয় (সময়কে এখন থেকে মাত্রা হিসেবেই ভাবতে শিখুন)। তাই ব্ল্যাকহোলের মতো ভারী বস্তুর কালের বক্রতা হয় অসীম। তাই ব্ল্যাকহোলের কাছে সময় ধীরে চলে। আপনি যদি ব্ল্যালহোলে পড়তে থাকেন আর আপনার কোনো বন্ধু যদি অনেক দূর থেকে আপনার পতন পর্যবেক্ষণ করে তার কাছে ব্যাপারটা এতটাই ধীরগতির মনে হবে যে সে আপনাকে পড়তে দেখার বদলে একটা বিন্দুতে স্থির অর্থাৎ ফুলস্টপে দেখবে (ওই যে বললাম সময় আপেক্ষিক)। আজীবন তার মনে হবে আপনি এক জায়গায়ই স্থির আছেন। ব্ল্যাকহোল এই যে সব কিছু টেনে নেয়, তা কিন্তু শুধু নিজের এলাকায় কেউ ঢুকে পড়লে তবেই। ব্ল্যাকহোলের এই এলাকার নাম হচ্ছে ঘটনা দিগন্ত। এই অঞ্চলে কেউ ঢুকে পড়লে ব্ল্যাকহলই হবে তার শেষ গন্তব্য৷ আর ব্ল্যাকহোল থেকে পুরো এলাকার ব্যাসার্ধকে বলে শোয়ার্জশিল্ড রেডিয়াস। খুব সহজ একটা সমীকরণ দিয়ে ব্ল্যাকহোলের এই শোয়ার্জশিল্ড রেডিয়াস বের করা সম্ভব। সমীকরণটি হচ্ছে 2GM/c2.

 

এখানে G হচ্ছে মহাকর্ষীয় ধ্রুবক, M হচ্ছে ভর আর c হচ্ছে আলোর কণা ফোটনের বেগ৷ (আপনি নিজের শোয়ার্জশিল্ড রেডিয়াস বের করে দেখতে পারেন, আপনার ব্যাসার্ধ কতটুকুতে নিয়ে আসতে পারলে আপনি ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবেন!)। যাহোক, এবার আপনাকে বলে রাখি ব্ল্যাকহোল কিন্তু শুধু তারা থেকেই উৎপন্ন হয় না। তারা থেকে উৎপন্ন হওয়া ব্ল্যাকহোলগুলোকে বলা হয় নাক্ষত্রিক ব্ল্যাকহোল। বিগব্যাং এর সময়ও কিছু ব্ল্যাকহোল উৎপন্ন হয়েছে যা সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল হিসেবে পরিচিত! এ ধরণের ব্ল্যাকহোল রয়েছে গ্যালাক্সি গুলোর কেন্দ্রে। আমাদের মিল্কিওয়ের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে যে ব্ল্যাকহোলটি রয়েছে তা স্যাজিটেরিয়াস এ স্টার হিসেবে পরিচিত৷ এবার সব শেষে খুব সংক্ষেপে পুরো বিষয়টার একটা সামারি করা যাক! ব্ল্যাকহোল হচ্ছে এমন কিছু মহাজাগতিক বস্তু যার মুক্তিবেগ এত বেশি যে আলোর কণা ফোটনও যদি এর ঘটনা দিগন্তে ঢুকে পরে তবে আর এর মহাকর্ষক্ষেত্রকে ফাঁকি দিতে পারে না। লেখা শেষ করা যাক ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে কিছু ফ্যাক্ট দিয়ে।

 

১. মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রর স্যাজিটেরিয়াস এ স্টার নামক সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল আছে। সূর্য সহ ছায়াপথের সকল স্টার সিস্টেম এই ব্ল্যাকহোল কে কেন্দ্র করে ঘুরে।

২. স্যাজিটেরিয়াস এ স্টারকে কেন্দ্র করে ঘুরে আসতে সূর্য যে সময় নেয় তাকে বলে গ্যালাক্টিক ইয়ার!

৩. ব্ল্যাকহোলের প্রবল মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে সময়ও বেকে যায়!

৪. ব্ল্যাকহোলের কাছে সময় ধীরে চলে।

৫. আমাদের সবচেয়ে কাছের ব্ল্যাকহোল ১৬০০ আলোকবর্ষ দূরে! এর নাম V4641mon.

৬. ULAS J1342+0928 কোয়াসারের সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে পুরানো ব্ল্যাকহোল।

৭. ব্ল্যাকহোলের ঘটনা দিগন্তে হকিং রেডিয়েশন ঘটে।

৮. বিজ্ঞানীরা M87 গ্যালাক্সির সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছেন!

৯. ব্ল্যাকহোল যতটা কালো আপনি ভাবেন আসলে ততোটা কালো নয়। প্রবল মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের আশেপাশে আলো বেকে থাকে। তাছাড়া এক্রেশন ডিস্ক দ্বারাও চিহ্নিত করা যায়।

১০. দুইটি ব্ল্যাকহোল মিলিত হয়ে আরো বড় নতুন ব্ল্যাকহোল তৈরি করতে পারে!

 

ব্ল্যাকহোল

 

ব্ল্যাকহোল

 

ব্ল্যাকহোল

 

ব্ল্যাকহোল

 

ব্ল্যাকহোল

 

ব্ল্যাকহোল

 

ব্ল্যাকহোল