আমার বাড়ি-জসীম উদ্দীন
আমার বাড়ি
জসীম উদ্দীন
আমার বাড়ি যাইও ভোমর,
বসতে দেব পিঁড়ে,
জলপান যে করতে দেব
শালি ধানের চিঁড়ে।
শালি ধানের চিঁড়ে দেব,
বিন্নি ধানের খই,
বাড়ির গাছের কবরী কলা,
গামছা-বাঁধা দই।
আম-কাঁঠালের বনের ধারে
শুয়ো আঁচল পাতি,
গাছের শাখা দুলিয়ে বাতাস
করব সারা রাতি।
চাঁদমুখে তোর চাঁদের চুমো
মাখিয়ে দেব সুখে,
তারা ফুলের মালা গাঁথি,
জড়িয়ে দেব বুকে।
গাই দোহনের শব্দ শুনি।
জেগো সকাল বেলা,
সারাটা দিন তোমায় লয়ে
করব আমি খেলা।
আমার বাড়ি ডালিম গাছে
ডালিম ফুলের হাসি,
কাজলা দিঘির কাজল জলে
হাঁসগুলি যায় ভাসি।
আমার বাড়ি যাইও ভোমর,
এই বরাবর পথ,
মৌরি ফুলের গন্ধ শুঁকে
থামিও তব রথ।
শব্দার্থ ও টীকা
ভোমর - মৌমাছি। ভ্রমরের কথ্য রূপ ভোমর। কবিতাটিতে কোনো বন্ধু বা প্রিয়জনকে
ভোমর বলে সম্বোধন করে নিজের বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
শালি ধান - এক প্রকার আমন ধান, যা হেমন্তকালে উৎপন্ন হয়।
বিন্নি ধান - বাংলাদেশের আদি জাতের ধানগুলোর একটি।
কবরী কলা - স্বাদের জন্য বিখ্যাত এক প্রকার কলা।
‘গামছা-বাঁধা দই’ – অধিক ঘনত্বের ফলে যে দই গামছায় রাখলেও রস গড়িয়ে পড়ে না। ‘শুয়ো আঁচল পাতি’ – আঁচল পেতে শুয়ে থেকো।
‘গাই দোহনের শব্দ’ – গাভীর দুধ দোহনের শব্দ।
কাজলা দিঘি - কাজলের মতো কালো জলের দিঘি।
কবি-পরিচিতি
কবি জসীম উদ্দীন ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর কবিতায় আমরা পল্লির মানুষ ও প্রকৃতির সহজ-সুন্দর রূপটি দেখতে পাই। পল্লির মাটি ও মানুষের সঙ্গে তার কবিহৃদয় যেন এক হয়ে মিশে আছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাহিনিকাব্য: ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’; কাব্যগ্রন্থ: ‘রাখালী’, ‘বালুচর’, ‘মাটির কান্না’; নাটক: ‘বেদের মেয়ে’। তার শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘হাসু’, ‘এক পয়সার বাঁশী’, ‘ডালিমকুমার’। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
পাঠ-পরিচিতি
কবিতাটি কবি জসীম উদ্দীনের ‘হাসু’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। এখানে কোনো বন্ধু বা প্রিয়জনকে নিজের গ্রামের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছেন কবি। তিনি তাকে আপ্যায়ন করতে চান শালি ধানের চিড়া, বিন্নি ধানের থই, কবরী কলা এবং গামছা বাঁধা দই দিয়ে। প্রকৃতির সান্নিধ্যে কেমন করে অতিথির প্রাণ জুড়াবে তারও এক নিবিড় পরিচয় আছে কবিতাটিতে। যুগ যুগ ধরেই অতিথি আপ্যায়নে বাঙালির সুনাম রয়েছে। অতিথির বিশ্রাম ও আনন্দের জন্য গৃহস্থের আন্তরিক প্রয়াস এ কবিতায় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অতিথি যে গৃহে এসেছেন সেই গৃহের গাছ, ফুল, পাখিও যেন অতিথিকে আপ্যায়নে উন্মুখ হয়ে আছে। অতিথিকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে সৌজন্য, শিষ্টাচার ও মানবপ্রেমের অসাধারণ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এ কবিতায়।
  18 Sep, 2019       1401   views